স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন ভাবনা কোনো না কোনো বই পড়তো।এত পরিমাণে বই পড়তো যে ছোটোখাটো একটা লাইব্রেরী গড়ে উঠেছিলো আমাদের ঘরে।রাত্রের খাবার শেষে যখন নিজেদের রুমে যেতাম তখন বইগুলো আমাকে পড়ে শোনাতো ভাবনা।ওর পড়ার ভিতর প্রায় সব বই-ই ছিলো ধর্মমুখী।কিন্তু একদিন দেখলাম ও Michael H. Hart এর The 100-A Ranking of the Most Influential Persons in History বইটা পড়ছে।প্রথমে আশ্চর্য হলেও পরে ভাবলাম যে এই বইয়ে মহানবী সাঃ কে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলোর মধ্য থেকে প্রথম স্থানে রাখা হয়েছে।যা নিয়ে একটা সময় বিভিন্ন মানুষের মাঝে বিতর্ক হলেও আমরা মুসলমানের কাছে ছিলো পূজনীয় একটা বই।কারণ মুসলমান ছাড়া মহানবী সাঃ কে কেউ শ্রেষ্ঠ মানতে রাজি নন এই অবস্থায় একজন বিধর্মী মানুষ যখন মহানবী সাঃ কে শ্রেষ্ঠ বলেছেন আবার তাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতর মানুষ বলেছে তাহলে তা আমাদের কাছে এক প্রকার পূজনীয়ই ধরতে গেলে।
আমি ভাবনার পাশে গিয়ে বসলাম।বসেই বলতে লাগলাম,
'এটা ওই বই না যেটাতে মহানবী সাঃ কে শ্রেষ্ঠতর বলা হয়েছে?এই কারণেই এই বই পড়ছো তাইনা?'
ভাবনা বই থেকে মুখ তুলে আমার দিকে ভ্রু-কুঁচকে চায় তারপর আমাকে জিজ্ঞাস করে,
'আপনাকে কে বলেছে এই বইতে মহানবী সাঃ কে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে?'
ওর প্রশ্ন শুনে আমারও ভ্রু-কুঁচকে উঠে।আমার এক কলিগ সেদিনও তো বললো এই বইটা পড়তে এটাতে নাকি মহানবী সাঃ কে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।আমি বিরক্তি নিয়ে বললাম,
'কি বলো!আমাকে তো সেদিনও নুরু ভাই বললেন এই বইটা পড়তে।এটাতে নাকি মহানবী সাঃ কে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে।'
'নুরু কে?'
'আমার কলিগ।'
'ওহ।আমি তো মনে করেছিলাম আপনার অফিসের পিয়ন বুঝি।কারণ এইরকম ভুলভাল বুঝে থাকা ব্যক্তিরা সাধারণত উচ্চশিক্ষায় শিক্ষি ব্যক্তি হয় না।কিন্তু আপনার সাথের লোক যেহুতে সে কোনো নিম্নমানের শিক্ষিত ব্যক্তি না।আর এটাই হলো বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা।'
আমি আবার ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞাস করলাম,
'সমস্যা মানি?ক্যামন ধরণের সমস্যা?'
'উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিরা ঈমান শক্ত করতে গিয়ে মডারেটপনায় যুক্ত হয়ে যায়।যার কারণে অন্য ধর্মাবলম্বীর বইয়ে মহানবী সাঃ কে প্রথম স্থানে দেখে বলে দেয় এখানে মহানবী সাঃ কে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করা হয়েছে।'
আমার বিরক্তি ধরে গেলো।ভাবনা কী বলতে চাইছে বুঝতে না পারায় কপালের ভাঁজ বেড়ে যাচ্ছিলো।আমি ভাবনাকে বিরক্তিভাব প্রকাশ করে বললাম,
'তুমি কী বলতে চাইছো একটু ক্লিয়ারলি বলবে প্লিজ?'
ভাবনা মুচকি হেসে দিয়ে বললো,
'আপনার কলিগ এত শিক্ষিত হয়ে কী বইয়ের নামটার দিকে একটু খেয়াল করেন নি?বইয়ের নাম The 100-A Ranking of the Most Influential Persons in History।এখানে Influential শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে যার অর্থ প্রভাবশালী শ্রেষ্ঠ না এটা কি সে জানে না?'
আমার চোখ বড় হয়ে গেলো।আমি ভাবতে লাগলাম শুধুমাত্র একটা শব্দের উপরে অধিকাংশ মুসলিমদের ধারণা টিকে আছে এটা খুবই দুঃখজনক।তারপরেও বইয়ের ব্যাপারে জানার জন্য ভাবনাকে বলতে লাগলাম,
'তো কি হয়েছে?প্রভাবশালী হিসেবেও যে প্রথম স্থানে রেখেছে ওটাই বা কম কিসে?'
ভাবনার ভ্রু-কুঁচকে গেলো।আমি বুঝতে পারলাম বইয়ের খুঁটিনাটি এখন আমাকে বলবে।ভাবনা ভারি গলায় বললো,
'আপনি জানেন একজন মুসলিমের এই বইয়ে মুহাম্মাদ সাঃ কে প্রভাবশালীদের তালিকায় প্রথম স্থানে দেখে উচ্ছাসিত হওয়া তার ঈমানের জন্য ক্ষতিকারক?'
বইয়ে মহানবী সাঃ কে প্রথম স্থানে দেখে কে-ই না উচ্ছাসিত হবে,এতে ঈমানের ক্ষতি কী তা বুঝতে পারলাম না তাই ভাবনাকে জিজ্ঞাস করলাম,
'বই পড়ে উচ্ছাসিত হওয়ার সাথে ঈমানের কী সম্পর্ক?'
'সম্পর্ক আছে।খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।Michael H. Hart মহানবী সাঃ এর প্রথম স্থানে থাকা নিয়ে সেই কারণগুলো দেখিয়েছেন তা হলো,
'খ্রিস্টান ধর্ম সম্প্রসারণের জন্য যিশু যতটুকু অবদান রেখেছে, ইসলাম ধর্ম সম্প্রসারণে মুহাম্মদের অবদান ছিল তার চেয়ে বেশি। এটা ঠিক যে, প্রধান নীতিশাস্ত্র ও খ্রিস্টধর্মের নৈতিক কল্পরূপের/অবকাঠামোর প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে যিশু (জুডাইজম থেকে যতটুকু ভিন্ন)। তবে সেন্ট পল একাধারে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্ব ও ধর্মান্তর সম্বন্ধীয় বিষয়ের প্রধান উন্নতিসাধন করে রচনা করেছেন নিউটেস্টামেন্টের একটা বিশাল অংশ।
খ্রিস্টানদের কাছে বাইবেল যতটা গুরুত্বপূর্ণ, মুসলিমদের কাছে কুরআন ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে কুরআনের মাধ্যমে মুহাম্মদের প্রভাব ব্যাপক। সম্ভবত খ্রিস্টধর্মে যিশুখ্রিস্ট ও সেন্ট পলের যৌথ অবদানের চেয়ে ইসলাম ধর্মে মুহাম্মদের অবদান অনেক বেশি।
তাছাড়াও, মুহাম্মদ ছিলেন একইসাথে একজন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ ও একজন ধর্মীয় নেতা। প্রকৃতপক্ষে, আরব বিজয়ের মূল হোঁতা হিসাবে তাঁর অবদান দেখলে তাঁকে হয়তো সর্বকালের সেরা রাজনৈতিক নেতা বলা যায়।
কেউ কেউ হয়তো বলবে যে, আরও অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার মতো এটাও অবশ্যম্ভাবী ছিল, অর্থাৎ মুহাম্মদ আরববাসীকে পথ প্রদর্শন না করলেও এই বিজয় আসতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, সাইমন বলিভারের জন্ম না হলেও সাউথ আমেরিকান কলোনি (দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশ) হয়তো স্পেন থেকে নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করে নিতো। কিন্তু আরব বিজয়ের ক্ষেত্রে এই কথা খাটে না।
মুহাম্মদের আগে এরকম কিছু ঘটেনি। তাই এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, তাঁকে ছাড়াই এই বিজয় সম্ভবপর ছিল। এটার সাথে তুলনা করার মতো মাত্র একটা ঘটনাই আছে মানব ইতিহাসে। তা হচ্ছে তেরোশো শতকে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে হওয়া মুঘল বিজয়। যাই হোক, এই বিজয়গুলো আরবের তুলনায় ব্যাপক, কিন্তু চিরস্থায়ী নয়। আর আজ মুঘলদের আয়ত্ত্বে/দখলে একমাত্র যেটুকু এলাকা আছে তা চেঙ্গিস খানের জীবদ্দশায় যতটুকু ছিল ততটুকুই।' [১]
আপনি খেয়াল করলে দেখবেন লেখক এখানে তাকে প্রথম স্থানে রেখেছেন দুটি কারণে,
প্রথমত,যুদ্ধক্ষেত্রে অসাধারণ নৈতৃত্ব দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার কারণে।
দ্বিতীয়ত,কোরআন রচনা করে তার মাধ্যমে ব্যাপক প্রভাব ফেলার জন্য।'
ভাবনা যে কারণগুলো দেখালো তার সবগুলোই স্পষ্ট ছিলো যার কারণে আমি ওকে জিজ্ঞাস করলাম,
'তো এখানে সমস্যাটা কোথায় সেটা বলো?'
'আপনি কি আসলেও সমস্যা খুঁজে পান নি?'
'না তো।'
ভাবনা একটা ছোট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,
'প্রথম যে কারণটা আছে তা দ্বারা আংশিক ইসলামকে গ্রহণ করা হচ্ছে আর বাকি ইসলামকে বাদ দেওয়া হচ্ছে।লেখক বলছেন ইসলামে মুহাম্মাদ সাঃ এর যে অবদান আছেন তা যুদ্ধক্ষেত্রে সফল হওয়ার কারণেই হয়েছে কিন্তু এটা সত্য নয় যে ইসলাম শুধু যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।এখানে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়াকে সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করা হচ্ছে।অথচ মহানবী সাঃ এর দ্বীন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে দাওয়াতে কতই না কষ্ট করেছেন।এমনকি নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে ভিজিয়েছেন তায়েফের ময়দান।ইসলাম কখনোই একমাত্র জিহাদ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় নি।কোরআনে অসংখ্য জায়গায় দ্বীনের দাওয়াতের ব্যাপারে বলা হয়েছে।[২]
কিন্তু এই বইয়ের এই কারণটাকে সত্য ধরলে ইসলামের মূল কথা এবং আয়াত থেকে আমরা দূর হয়ে যাচ্ছি যার কারণে আমাদের ঈমান ক্রমশই দুর্বল হতে থাকবে।'
ভাবনার বুঝানোর পদ্ধতি দেখে আমি অবাক না হয়ে পারলাম না।আমি ভাবনাকে জিজ্ঞাস করলাম,
'দ্বিতীয় কারণটা?'
'দ্বিতীয় কারণটা তো আরো স্পষ্ট।লেখক দাবি করছেন মহানবী সাঃ মুসলমানদের মাঝে প্রভাব বিস্তার করেছেন কোরআনের মাধ্যমে।তিনি বলছেন সেন্ট পল নিউ স্টেটমেন্টের একটা বিশাল অংশ রচনা করেছেন ঠিক তেমনি মহানবী সাঃ কোরআন রচনা করে মুসলিমদের রীতিনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছেন অথচ কোরআন মহানবী সাঃ এর কোনো লেখা কিতাব নন।কোরআন এবং তার প্রতিটা অংশের রচিয়তা মহান আল্লাহতালা।আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি কোরআন আল্লাহর ঐশী বাণী।আল্লাহতালা বলেন,
‘এটা সেই কিতাব; যাতে কোনো সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই।' [৩]
এখন লেখকের কথায় যদি মানতে যাই তাহলে কোরআন আল্লাহর বাণী না বলে বিশ্বাস করতে হবে।আর আল্লাহর কোরআন এটা বিশ্বাস না করা ব্যক্তির ঈমানের ব্যাপারে সন্দেহ হয় আমার।'
বইটার ভিতর মহানবী সাঃ এর অবস্থান এর পিছে লুকিয়ে থাকা কারণ বুঝতে পেরে শুধু এতটুকুই মনে আসলো আমরা মুসলমানরা কতটাই না আবেগ প্রবণ।মহানবী সাঃ কে কতিপত মানুষের সাথে প্রথম স্থানে দেখে আবেগ ধরে রাখতে না পেরে বইটাকে ইসলামের সাথে যুক্ত করতেও দ্বিধা করি নি।অথচ মহানবী সাঃ বলেন,
কোনো ব্যাক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ঠ যে, সে যা শুনে তাই যাচাই না করে বিশ্বাস করে এবং অন্যের কাছে প্রচার করে। [৪]
আবেগ আর মোডারেটপনা আমাদের ঈমানকে ক্রমশই দুর্বল করে দিচ্ছে।আমি দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবনাকে বললাম,
'এত সুন্দর করে বুঝানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।আমি গিয়ে কালকে গিয়েই নুরু ভাইকে এই ব্যাপারে বলে দিবো।'
'অবশ্যই বলবেন।সাথে তাকে এও বলবেন যে মহানবী সাঃ এর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ খুঁজতে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে যাওয়ার কোনো দরকার নেই।কারণ আল্লাহ মহানবী সাঃ সম্পর্কে বলেন,
'আমি তো আপনাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।' [৫]
তার আমাদের উদ্দেশ্য করে বলেন,
‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে আছে উত্তম আদর্শ।' [৬]
মহানবী সাঃ তার নিজ সম্পর্কে বলেছেন,
‘আল্লাহপাকের নিকট সকল সৃষ্টির মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ হলাম আমি।এতে আমার গর্বের কিছুই নেই।' [৭]
মহানবী সাঃ মুসলিমদের কাছে হওয়া উচিত সর্বশ্রেষ্ঠ মানব এবং তার আদর্শই আমাদের কাছে একমাত্র গ্রহনীয়।এখন কে তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বললো অথবা না বললো তা দেখে আমাদের কোনো লাভ নেই কারণ মুমিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
'তারা বলে আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম, আর এইরূপ লোকেরা প্রকৃত সফলকাম।' [৮]
.
১: অনুবাদ-হিমেল রহমান।
২: সূরা মায়েদা-৬৭,সূরা নাহল-৩৫,সূরা আল ইমরান-১০৪,১১০,সূরা আরাফ-৬২।(আরো অনেক)
৩: সূরা বাকারা,০২।
৪:সহীহ মুসলিম,১/৫।
৫:সূরা আম্বিয়া,১০৭।
৬:সূরা আহযাব,২১।
৭: তিরিমিযী শরীফ।
৮:সূরা আন নূর,৫১।